কবিতা’র একখানি ছোট বই ছিলো আমার। হাশেম খানে’র জলরঙ ইলাস্ট্রেশন তাতে- কেবল শাদা আর কালো। বইটা খুললেই ভেতর থেকে ক্যামন বিষাদময় বর্ষা ঝিরঝির করে বের হয়ে আসতো। ইনস্তাগ্রামে’র চৌকো ফ্রেমে নয়- সাধু মতিনে’র দ্বীপে যেমন করে দ্যাখেছিলাম- ঠিক তেমন একটা আশমান মেলে যেতো। পিঁপড়ার মত অষ্টপ্রহর গাড়ি দৌড়ে যাওয়ার একটা মেট্রোপলিসের শিশু ছিলেম- বুনো হাঁসের দল উড়ে গেলে অবিকল এরোপ্লেনের মত বোঁ-বোঁ আওয়াজ হয়- এমন নিঃসর্গতত্ত্ব জানার পথ ছিলোনা আর। কবিতা’র বইটা হাতছাড়া করতাম না তাই, কখনোই।
বাবাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম- ঈশান কোণটা কোনদিকে। বাবা’র চুল তখনো শুভ্র কাশফুলের মতন হয়ে ওঠেনি। বাইফোকাল নাকে বসিয়ে গম্ভীর মুখে তিনি খাতা টেনে নিলেন। খাতার সফেদ জমিনে পাইলট কলমের সরু নিব দিয়ে টেনে টেনে একটা চতুষ্কোণ আঁকলেন। উত্তর-দক্ষিণ ছাড়াও আরো চারটে দিকের হদিস জানলাম সেদিন। অগ্নি-বায়ু-ঈশান-নৈঋত। খাতাটা নিয়ে আমাদের ভাঙ্গাচোরা গাঁথুনি’র তিনতলা’র বারান্দায় দাঁড়ালাম- ঈশান কোণটা চিনে নেয়া জরুরি। জলবৃষ্টি’র মেঘের মাহফিল নাকি ঠিকঠাক ঐদিকে বসে- কবিতা’র বইয়ে তাই-ই লিখা। বৃক্ষদলের সাথে সেদিনই ছিলো আমার প্রথম কথোপকথন।
আমাদের অশ্বত্থ ছাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে বিল্ডিংটা পার হ’লেই একটা ছোট বস্তিমতন পড়তো। বস্তি মানে- ফুটপাতে’র উপর ক’টা নারকেল পাতা, তার উপর আসমানী রঙ পলিথিন দিয়ে বানানো এলোমেলো কিছু খুপড়ি ঘর, ভাসমান কিছু পরিবারের পদ্মপাতা’র সংসার। সেগুলো থেকে খিস্তি ভেসে আসতো উদয়াস্ত- বিশুদ্ধ মৈমনসিংহের টানে। কেবল বাদলা দিনেই তাদের ঠোঁটগুলো এক লহমা বিশ্রাম নিতো বোধ করি, আটপৌরে গালিগালাজ চুলোয় উঠতো- উদ্বেগে তারা নোংরা হাড়ি-কুরিগুলো খুপড়িতে টেনে নিতো। ঝড় একটু গাঢ় হ’লেই “লা ইলাহা” বলে মাতম শুরু হ’তো। অর্ধউলঙ্গ একদল নারীপুরুষকে দেখতাম- দৌড়ে দৌড়ে পল্কা পলিথিনগুলো ধরে আকড়ে রাখছে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতন। এই বস্তিটা পার হ’লেই বিশ্বরোড। তারপরেই একটা মিটারগেজ রেললাইনকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিলো বৃক্ষদল। আমি মনে করতাম- এই রেললাইনের পেছনে আর কোন পৃথিবী নেই, এরপরেই মেঘ এবং অন্তরীক্ষ। আমার শৈশবের পৃথিবী’র শেষ সীমানা।
বৃক্ষদলের পরিচয় দেয়াটা আবশ্যক হয়ে গেছে। ঐ যে মিটারগেজ লাইনটা’র কথা বললাম- তার পাশ দিয়ে একসার বিশাল গাছ এলোমেলো ডাল-পালা স্ক্রু’র মত প্যাঁচ কেটে ষাট-সত্তুর ফিট উঁচুতে উঠে গিয়েছে প্রথমে। তারপর কৈশিক জালিকা’র মত শাখা-প্রশাখা মেলে দিয়ে আকাশ ঢেকে দিয়েছে। সবচে’ উঁচু গাছটার একদম মাথায় একটা প্রকান্ড চিল বাসা বেঁধেছিলো। দখিনা বায়ু একটুখানি বইলেই ঝিরঝির একটা শব্দে মদির হ’তো চারপাশ- আমি মনে করতাম সেটা গাছগুলো’র নিজস্ব ভাষা, তাদের মাঝে কথোপকথন চলছে। আর ঝড় শুরু হ’লে দুর্বার বাতাস গাছগুলো’র শাখা-প্রশাখায় আহত হয়ে ফিরে যেতো- শোঁ-শোঁ আওয়াজ রূপ নিতো কোন পরাবাস্তব শাঁখের ধ্বণিতে। গাছগুলো নাকি আইউব শাহী’র আমলে লাগানো। স্পেস-টাইমের সেলাইকে অত নিগূঢ়ভাবে বোঝার মত মস্তিষ্ক ছিলোনা শৈশবে, মনে হ’তো আইউব শাহী সম্ভবত শতাব্দী তিনেক আগের যুগ। গুরুগম্ভীর বৃক্ষদল তাই স্বল্প আয়াসেই আমার কাছ থেকে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত সমীহ আদায় করে নিতো।
বৃক্ষদলকে নিয়ে স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কের ভেতর এখনও গাঢ়, পোর্ত্রা ফিল্মরোলে তোলা একগাদা ছবি’র মত সাইন্যাপ্সে জমাট বেঁধে আছে। মনে আছে- একদিন ভোরে হঠাৎ একদল নারীপুরুষ এসে হাজির। ছন্নছাড়া, পরনে গেরুয়া পিরান, রুদ্রাক্ষ। কাঁচাপাকা দাড়ি’র জটা আর নেশা জর্জর চোখ নিয়ে গাছগুলো’র গুড়িতে রীতিমত হল্লা করে পসরা সাজিয়ে বসে গেলো। দূর থেকে রাতের অন্ধকারে দ্যাখা যেতো- চল্লিশ ওয়াটের বালবের আলোয় তাদের গরিমা গানের আসর। চূড়া করে বাঁধা চুল নিয়ে এক প্রৌঢ়ের ছায়া পড়তো সামিয়ানায়, দূর থেকে দেখে মনে হ’তো- কোন নিশিগ্রস্ত মানুষ, দম দেওয়া পুতুলের মত অবিকল নেচে যাচ্ছে দোতারা হাতে। বাবা’র হাত ধরে একদিন কাছে চলে গিয়েছিলাম। হ্যাজাক লাইটের উত্তপ্ত হলদে আলো আর একদম র’ গাঁজা’র তীব্র ঘ্রাণ করোটি’র ভেতরে রীতিমত জ্বলুনি ধরিয়ে দেয়- তাও অপার্থিব রহস্য দেখেছিলেম সেদিন। সেই চিরহরিৎ বৃক্ষদল কি মমতায়ই না আশ্রয় দিয়েছিলো এই রহস্যগুলোকে, যেমন করে আশ্রয় দিয়েছিলো সেই প্রকান্ড চিলকে।
এই রহস্য, সেই চিল, পরাবাস্তব শাঁখ- সবকিছু একদিন লীন হয়ে গেলো। যেনো তাদের অস্তিত্ব কখনোই এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে’র কোন গ্রহেই ছিলো না। কোনকালেই ছিলো না। এটাই বোধ করি মৃত্যু’র নিগূঢ় কথা- সকল অস্তিত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে হারিয়ে যাওয়া, মুছে যাওয়া। রেডিয়োহেডের গানটা মনে আছে? হাউ টু ডিসএপিয়ার কমপ্লিটলি?
বৃক্ষদল তেমনি করে মুছে গেলো একদিন। ব্রোঞ্জরঙা অগণন মানুষ এলো- মর্চে পড়া মিশমিশে কালো কিন্তু ক্ষুরধার করাত ধরা তাদের পেশিবহুল হাতে। হন্তারক মনে হয়নি তাদের দেখে। হন্তারক তারা নয়ও, ক্ষুধার অন্নের যোগাড়যন্ত্র করতেই তাদের আগমন। সেই যে মিটারগেজ রেললাইনটার কথা বললাম- সেটা নাকি ব্রডগেজ হচ্ছে। দুই সমান্তরাল বাহু’র মাঝে বেড় বাড়বে, তাই নগরপিতার হুকুম- উজাড় করো রেললাইনের দুপাশে আছে যত গাছ।
ব্রোঞ্জরঙা লোকগুলো অসম্ভব কর্মি। একদিনের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেলো বৃক্ষদলের শেষ গাছটিও।
সেদিন মাঝরাত্রিতে প্রচন্ড ঝড় হয়েছিলো। প্রবল বাতাসের রুদ্ররোষে আমাদের নড়বড়ে গাঁথুনি’র দালানটা প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠছিলো মৃগী রোগী’র মতন করে। লোডশেডিংয়ে পুরো এলাকায় ভূতের মত অন্ধকার। বস্তিবাসীরা প্রথমে কিছুক্ষন লা-ইলাহা বলে চ্যাঁচিয়েছিলো, তারাও নিশ্চুপ, আমাদের মতই। প্রকৃতি’র নির্দয় তান্ডবের কাছে ম্রিয়মান হয়ে সেইদিনই ঠাহর করেছিলাম- এই আঘাতগুলো এতকাল বৃক্ষদল সয়েছে- আমাদেরকে কিছুমাত্র টের পেতে দেয়নি। বরং বাতাসের শোঁ-শোঁ ধ্বণিকে শাঁখের আওয়াজ বানিয়ে দিয়েছে- পৃথিবী’র নিপুণতম স্যাক্সোফোনেরও সাধ্য কি আছে এমন অবাধ্য বাতাস দিয়ে সুর তোলার?
ফজরের আযানের বেশ কিছুক্ষণ পর বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম। ভোর তখন তেমন গাঢ় নেই। বৃক্ষদল এখন আর নেই। তাই এতকালের পরিচিত পৃথিবী’র সীমানা অযাচিতভাবে অসীমে গিয়ে ঠেকেছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম- একটা অপরিচিত নেক্রোপলিস নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সম্মুখে। আবর্জনায় টইটুম্বুর ডোবা, তার পাশে একটা গার্মেন্টস, তার পেছনে একটা- তার সামনে একটা, এই শহর তো দেখছি কারখানার অভয়ারণ্য! কোন একটা সিমেন্ট-রঙা দালানের ছাদে দানবীয় বিলবোর্ড। ফিনফিনে শাড়ী পরা নগ্নবাহু’র এক ফর্শা তরুণী’র ছবি তাতে- জলের মত স্বচ্ছ শাড়ী ভেদ করে তার শরীরের বাঁক, নাভীমূল স্পষ্ট দেখা যায়। দালানের নিচে একটা ছোট গেইট- তাতে পিলপিল করে ঢুকছে শত-শত যুবতী। তারা কেউ-ই বিলবোর্ডের তরুণীটি’র মত নয়। শস্তা প্রিন্টের মলিন জামা, হাতে রূপো-রঙের টিফিন ক্যারিয়ার আর চেহারায় ক্লেশের স্পষ্ট ছাপ। কেমন নির্দয় একটা বৈপরীত্য… বিলবোর্ডের ঐ তরুণী’র মত মোহনীয় হাসি তাদের ঘর্মাক্ত ঠোঁটে কখনো কি ফোটেছে?
বৃক্ষদল এই নগরের সকল অসুন্দরকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলো এতকাল। তেমন কোন আড়াল এখন আর নেই। অসুন্দর এবং বাস্তবতা মিলেমিশে একটা অসুস্থ জগত তৈরি করেছে, সেখানেই অহর্নিশ যাপন আমাদের। সেখানেই নাইট্রিক অক্সাইডে প্রশ্বাস নেই। সেখানেই বুড়োই। হারিয়ে যাই।