স্যালি ক্লার্ক এবং জামির হোসেন

পিএইচডি’র এক পর্যায়ে এসে আমাকে ইনফরমেশন থিয়োরি’র বেশ কিছু বিষয় আত্মস্থ করতে হয়। তখন স্যার ডেভিড জে সি ম্যাককেই’র নাম আমি প্রথমবারের মত শুনি। একজন সত্যিকারের পলিম্যাথ বলতে যা বোঝায়- উনি তাই-ই। পঞ্চাশ বছরেরও কম আয়ুষ্কাল নিয়ে উনি এত বৈচিত্র্যময় সব শাখায় মৌলিক অবদান রেখে গেছেন- ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। লো-ডেনসিটি পেয়ারিটি কোডিং, বায়েসিয়ান নিউরাল নেটওয়ার্ক (এটা একটু মনে রাখতে হবে, কারণ এই প্রসঙ্গে আমরা আসবো) থেকে শুরু করে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কিবোর্ড তৈরি করা এবং রিনিউয়েবল এনার্জি নিয়ে লেখালেখি করা – আমার বড্ড অবাক লাগে। তাঁর চেয়েও বড়ো কথা হচ্ছে – তিনি তাঁর একাডেমিক প্রজ্ঞা ব্যবহার করে স্বপ্রণোদিত হয়ে একটা প্রবল অবিচার রুখে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন [১]। ঘটনাটা ছোট করে উল্লেখ করি।

স্যালি ক্লার্ক নাম্নী একজন বৃটিশ নারী’র পরপর দুই সন্তান Sudden Infant Death Syndrome (SIDS) সংক্রান্ত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন। পরিতাপের বিষয়- বৃটিশ আদালতে এই নারীকে হত্যা মামলায় কাঠগড়ায় নেয়া হয় যেখানে রাষ্ট্রপক্ষ অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে পরিসংখ্যান এবং সম্ভাব্যতা ব্যবহার করে দেখান যে – উভয় সন্তানের SIDS সংক্রান্ত জটিলতায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম (প্রায় ১/৭৩০০০০০০০)। এই ঘটনা স্যার ম্যাককেই’র দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি দ্রুতই ধরতে পারেন যে, রাষ্ট্রপক্ষের এপ্রোচ পুরোপুরি ভুল। প্রথম শিশু’র মৃত্যুর পরপরই যে “পোস্টেরিয়র” সম্ভাব্যতা তৈরি হয়, সেটা দ্বিতীয় শিশু’র মৃত্যুর সম্ভাব্যতা অংক কষে বের করার সময় “প্রায়োর” হিশেবে ব্যবহার করা দরকার ছিল। বায়েসিয়ান নিউরাল নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকার কারণে এই ধরণের সমস্যা তাঁর কাছে একেবারেই ছেলেখেলা, আদতেও তাই। স্যালি ক্লার্কের মুক্তির দাবিতে যেসব ক্যাম্পেইন চলছিলো, সেগুলোতে তিনি সক্রিয় হোন। অবশেষে তিন বছর অকারণে কারাভোগের পর স্যালি মুক্তি পান। আগ্রহীরা উইকিতে বিস্তারিত দেখে নিতে পারেন [২]।


প্রায় একযুগ আগে ক্ষণজন্মা চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ এবং চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনির ভয়াবহ মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি তারেক মাসুদের একজন প্রবল অনুরাগী। গ্রামীণফোনে প্রকৌশলী হিশেবে দায়িত্বপালন করার সময় নড়াইল ছিলো আমার এখতিয়ারভুক্ত জেলাগুলোর মাঝে অন্যতম। সেখানেই বাস করতেন শিল্পি সুলতান এবং সেখানেই তারেক-মিশুক যুগলের সুনিপুণ হাতে চিত্রস্থ হয়েছিলো “আদম সুরত”। আমার মনে আছে- চিত্রা’র পাড়ে গেলেই তারেক মাসুদ এবং সুলতানের কথা ভেবে শ্রদ্ধা এবং বিষণ্ণতায় মন ভারি হয়ে আসতো।

সেই দুর্ঘটনায় “ঘাতক বাস”টি চালাচ্ছিলেন জামির হোসেন। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কাশিমপুর কারাগারে সাজাভোগের মাঝেই ২০২০ সালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হোন এবং মৃত্যুবরণ করেন। প্রশ্ন হচ্ছে- এই যে জামির হোসেন দীর্ঘ সময় বিচার প্রকৃয়ার ভেতর দিয়ে গেলেন, কারাভোগ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত ভগ্নস্বাস্থ্যের কাছে হেরেই গেলেন – তিনি কি আদৌ এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিলেন কি না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর শামসুল হক। “জামির হোসেনের মৃত্যু এবং আমাদের দায়” শীর্ষক প্রবন্ধে [৩] প্রফেসর শামসুল হক তাঁর ফয়সালা পেশ করেছেন। তাঁর অনুসন্ধানের ফলাফল হচ্ছে – জামির হোসেন নির্দোষ ছিলেন। জামির হোসেনের ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করতে স্বপ্রণোদিতে হয়ে আইনমন্ত্রী’র দ্বারস্থও হয়ে ছিলেন প্রফেসর শামসুল হক। তার আগেই জামির হোসেনের প্রয়াণ ঘটে।


স্যালি ক্লার্ক কারামুক্তি’র পর কখনোই আর আটপৌরে জীবনে ফিরতে পারেননি। নানা ধরণের ট্রমা এবং বিষণ্ণতায় ভুগে এলকোহল ইনটক্সিনেশনে অল্প কয়েক বছরের মাঝেই মারা যান।


আমি স্যালি ক্লার্ক এবং জামির হোসেন কিংবা স্যার ম্যাককেই এবং প্রফেসর শামসুল হক – এঁদের মাঝে সাযুজ্য খুঁজে পাই। সেটাই এই আপাত খাপছাড়া লেখার পেছনের মূল বয়ান।

রেফারেন্স

[১] https://www.theguardian.com/environment/2016/apr/18/sir-david-mackay-obituary

[২] https://en.wikipedia.org/wiki/Sally_Clark

[৩] https://www.dw.com/bn/বাসচালক-জামিরের-মৃত্যুতে-আমাদের-দায়/a-54417575

Leave a comment