আমার জন্ম উনিশশো নব্বই সালের দশই নভেম্বর। ঐ সময় পুরো ঢাকায় কারফিউ চলছে, প্রবল থমথমে ভাব। স্বৈরাচারী এরশাদ প্রায় পতনোন্মুখ, নূর হোসেন বুকে পিঠে গণতন্ত্রের গান লিখে ঝাঁঝরা হয়ে গেছেন বুলেটে। এর মধ্যে আব্বু তাঁর ফিরোজা ভেসপা’র মাথায় একটা সাইনবোর্ডের মত বসিয়ে বের হয়ে গেলেন আমাকে দেখতে, মুক্তি নার্সিং হোমে। এখনো আছে মুক্তি নার্সিং হোম, খিলগাঁ মাটির মসজিদের আশেপাশেই, একটা লাল ইটের দালানে।
গতকাল আমার বয়স ত্রিশ হ’লো। তার ঠিক দশদিন আগেই আব্বু চলে গেছেন।
আমি আব্বুকে নিয়ে আমার সবচে’ প্রাচীন স্মৃতিটুকু মনে করতে চেষ্টা করছিলাম। আমার আবছাভাবে ঐ ফিরোজা রঙয়ের ভেসপাটা’র কথাই মনে পড়লো। আব্বু আমাকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন, আমি সম্ভবত নার্সারিতে পড়ি। ভেসপা’র সামনে যে পা’দানিটা থাকে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছি অত্যন্ত বিব্রত মুখে। কারণ, আব্বু বিকট সুরে, ভেসপা’র ভটভটি আওয়াজ ছাপিয়ে রাস্তাসুদ্ধ লোককে শুনিয়ে গান করছেন। সেই গানের ভাষা বাংলা নয়, হিন্দি নয়, ইঙরাজি তো নয়ই। গানের ভাষা পুরোপুরি আব্বু’র আবিষ্কার, সেই ভাষায় আব্বু আমাকে আর আমার ছোটভাইকে ডাকতেন।
এবার আব্বু’র সাথে আমার সর্বশেষ দেখা’র স্মৃতিটাও টুকে রাখি। আমি অত্যন্ত বিস্মৃতিপ্রবণ মানুষ।
পিএইচডি ছাত্রদের আয় সাকুল্যে নিতান্তই কম থাকে, আমিও তার ব্যত্যয় নই। ফি বছর দেশে যাওয়া আমার জনয় অত্যন্ত দুর্মূল্য একটা ব্যাপার। তাই গত বছর দেশে যাবো, সে চিন্তা মাথা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলাম। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি কোন একদিন আব্বুকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘেমে একদম নাইয়ে গেছিলাম, মনে হ’লো আব্বুকে দেখা খুব প্রয়োজন। স্ত্রী’র সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপ সেরেই সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশে যাচ্ছি।
দেশ থেকে ফেরার সময় গাড়িতে উঠেছি। আমি এতবার ঘর ছেড়েছি যে, ঘর এবং তদসংক্রান্ত আবেগগুলো কেমন ম্লান হ’তে হ’তে প্রায় অপরিচিত হয়ে গেছে, যেভাবে আলোকদূষণের শহরে রাতের আসমান মেলে ধরে ম্রিয়মাণ নক্ষত্ররাজি। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, গলায় দলা পাকাচ্ছে কিছু। আমি গাড়ি’র সাইড মিররে দেখলাম, আব্বু স্থাণু’র মতন দাঁড়িয়ে আছেন নিস্পন্দ, বাড়ি’র মূল ফটকের সামনে। জানুয়ারি’র অকস্মাৎ কুয়াশাতে আবছা হয়ে গেলেন আব্বু।
আব্বু আবছা হ’তে হ’তে অদৃশ্যই হয়ে গেলেন। আর কখনো দেখা হবেনা।
নভেম্বর ১১, ২০২০